অনেক দিন পর বাসায়
এসেছি । তাই খাওয়া-দাওয়ার আর বালাই নেই । দিন-রাত মিলিয়ে যে কয় বেলা খাই তার কোন
ঠিকানা নেই । একদিন বিকালে বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছি আর পেপার পড়ছি । মা কিচেনে কাজ
করছিল । এমন সময় হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ । আগেই বলে রাখা ভাল- আমরা মফস্বলের
একটি ভাড়া বাসায় থাকি । বাবা সরকারী কর্মকর্তা । ছোট বোন কলেজে পড়ে ।
মা বলে উঠল, “বাবা,
দেখত গেটে কে এসেছে ?”
আমি বললাম “হ্যা, মা
দেখছি ।”
গেট খুলতেই দেখলাম
একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে ।পরনে ছিল থ্রি-পিস । চেহারাতে ভদ্র পরিবারের মেয়ে বলেই মনে
হল ।আর দেখতেও সুন্দর বলতে যা বোঝায় । আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-“কাকে চাই ?”
সে উত্তর দিল “আমরা
পাশের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া । আন্টি আছেন বাসায় ?”
আরও বলে রাখা ভাল যে
আমি সিলেট এ থাকি । ওখানেই একাটা কম্পানিতে চাকরি করি । অনেক দিন পরপর বাসায় আসি ।
এবার আসলাম প্রায় ৫ মাস পর, শীতের ছুটিতে । তাই প্রতিবেশীদের সম্পর্কে তেমন একটা
অবগত নই , মানে তাদের খুব একটা চিনিও না । তার উপর মেয়েটা বলল , নতুন এসেছে । তাই
দেরি না করে মাকে ডাক দিলাম । বললাম, “তোমাকে কে যেন ডাকছে ।” যেহেতু অপরিচিত, তাই
ভেতরে আসতে বলার সাহসটা পেলাম না ।
মা বলে উঠল, “কে এসেছে
আবার এখন ?” এই বলতে বলতে মা বেরিয়ে এসে বলল, “ও, প্রিয়াংকা, তুমি !!! এস, ভেতরে
এস ।” আর আমাকে বলল, “কিরে, মেহমান আসলে কি ভেতরে আসতে বলতে হয় সেটাও জানিস না ?”
আমি বললাম,“আসলে
মা,...............”
মা বলল,“থাক, আর তোকে
আর কিছু বলতে হবে না ।”
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
“সরি L” । হয়ত শব্দটি
মেয়েটির কানে পৌঁছায়নি ।
মা তাকে নিয়ে ভেতরে
গেল । আর আমাকে বলল, “গেটটা লাগিয়ে দিয়ে আয় ।”
আমি যথারীতি গেটটা
লাগিয়ে বেলকনিতে চলে গেলাম । আড়িপেতে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম ।
কিছুক্ষণ পর মা ডেকে
বলল, “গেটটা লাগিয়ে দিয়ে আয় তো, প্রিয়াংকা চলে যাবে ?”
আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে
যেয়ে দেখি মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আমি এবার তার সাথে কথার প্রথম সুযোগে বললাম “সরি L”
সে বলল, “নো প্রবলেম J”
একটু যেচে গিয়ে বললাম,
“আমার নাম স্বাধীন ।”
সে বলল, “আজ আসি।
অন্যদিন কথা হবে। বায়...”
আমিও তাকে বায় জানিয়ে
ভেতরে চলে আসলাম। সেদিন আর কোন কিছুতে মন বসছিল না। শুধু মেয়েটার কথা মনে পড়ছিল। তাকে
ছাড়া যেন কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তার ওই অপলক দৃষ্টি, নিকশ-কাল দীর্ঘ চুল,
মায়াবী চাহনি আর অস্পষ্ট হাসি আমাকে একটা ভাবনাতে আবদ্ধ করে ফেলল । সেই ভাবনায় আমি
হারিয়ে যেতে চাইলাম দুর-বহুদূর। তাকে নিয়ে ভাবনার বিস্তৃতির কোন সীমা খুঁজে পেলাম
না। আমি যেন তার
সাথে মিশে যেতে চাইলাম ।
এরপর তাকে মাঝে মাঝে
দূর থেকে দেখতাম। আর ভাবতাম, “মানুষ মনে হয় এই জন্যই সুন্দরের পূজারী ।” সে যখন
ভেজা চুলগুলো রোদে এলিয়ে বসে থাকত, তখন সেই চুল বেয়ে ঝরা পানিগুলো আমার হৃদয়কে
সিক্ত করে যেত । আমি ছুটে যেতে চাইতাম তার কাছে। বারবার কেন যানি মনে হত, সেও বুঝি
আমকে দেখছে।এভাবে বেশ কিছুদিন আমাদের মধ্যে চোখাচোখি চলতে থাকল।
এরপর একদিন সীমার বাঁধ
ভেঙে দেখা করতে গেলাম তার কাছে, আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে। ওর নাম রাশেদ, ওর খুব
চেনা। যদিও অনেকটা প্রস্তুত ছিলাম, তার পরও প্রথম কথা বলতে সংকোচ বোধ করছিলাম ।
রাশেদ আমাকে বারবার পেছন থেকে খুঁচা দিছিল। আর একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছিলাম তার দিকে।
যেহেতু আগে মেয়দের সাথে তেমন একটা কথা বলতাম না (আসলে মেয়েদের দেখলে ১০০ গজ দূরে
থাকতাম), তাই লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল আমার মুখ। শেষমেশ বলেই ফেললাম, “আই লাভ ইউ J”। প্রথমবারের মত প্রোপজ করে ফেললাম, যা ছিল আমার জীবনে
কোন মেয়েকে করা প্রথম প্রোপজ। কোন উত্তর না দিলেও, “নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ” বলে
মনে করলাম। এরপর মোবাইল নম্বর আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের ফনালাপ চলতে থাকল ।
আমার ফিরে যাবার সময়
ঘনিয়ে আসল। ফিরে যেতে হবে সেই পুরনো ঠিকানায়। কিন্তু যেতে যে এবার আর মন চাইছে না।
থেকে যেতে চাই আরও কিছু দিন। তা মনে হয় আর হল না। প্রকৃতির নিয়মে আবার আমাকে ফিরে
আসতে হল। আফসোস শুধু একটাই, আসার সময় একটি বারের জন্য দেখা হল না। কিছুটা সময়
একান্তে কাটাতে পারলাম না তার সাথে। বাসায় যতদিন ছিলাম, আমার সারাটি দিন কাটত তাকে
ভেবেভেবে, যেমনটি কাটছে এখানেও । আমি তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না। তাকে
একটি বার দেখতে চাওয়ার প্রবণতা আমার মাঝে বারবার কাজ করছে।
সিলেটে ফিরে যাবার পরও
তার সাথে যোগাযোগ নিয়মিত চলতে থাকল।
এই ভাবতে ভাবতে ২ মাস
কেটে গেল। এরপর ঈদের ছুটি। বাড়িতে আসার পালা। আবার সেই মুখটি চোখের সামনে হাসবে,
খেলবে, কথার ফুলঝুরি ফোটাবে। ভাবতেই কেমন আনন্দ লাগছে।
কিন্তু কেমন করে যেন
সবকিছু পাল্টে যেতে লাগল। বাসায় আসার কিছুদিন আগে থেকে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ
করতে পারলাম না। ফোনটা শুধু সুইচড অফ পাচ্ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে, আমার
সাথে কি ঘটতে যাচ্ছে।
কিন্তু বাড়িতে আসার পর
দেখল অন্য চিত্র। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। শেষবারের জন্য কথাটাও বলতে পারলাম না। চোখের
দেখাটাও দেখতে পেলাম না। “কি অন্যায় করেছিলাম আমি ?”, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। “সে
আমাকে ফেলে চলে গেল, একটিবারের জন্যও কেন জানাল না ?”
নিজেকে শেষ করে দিতে
ইছে হছিল। কিন্তু একটা চিন্তা আমাকে বেঁধে দিল । আমরা দুই ভাই বোন । আমি বড়। ছোট
একটি বোন আছে। তাই বাবা-মার আমার উপর যেমন ভালবাসা তেমনি ভরসা।
এভাবে কয়েকদিন মনমরা
অবস্থায় বসে থাকতাম একাএকা, ভাবতাম শুধু তার কথা।
একদিন মা আমাকে ডেকে
জিজ্ঞাসা করল, “কি হইছে তোর ? সারাদিন একাএকা থাকিস, কারও সাথে কোন কথা বলিস না।
কি যেন চিন্তা করিস। এবার এসে কিছুই খাচ্ছিস না। কিছু খেতে দিলে বলছিস, এখন না পরে।”
আমি শুধু বললাম, “কই,
কিছু হয়নিত মা ।” আর কিছু বলতেও পারলাম না। কথা যে আমার আর বেরুছিল না।
পাশের বাসার আঙ্কেল
এসেছিল এইসময়। তিনি আমার মাকে বললেন “বিয়ে দিয়ে দিন ছেলেকে। তাহলেই সংসারে মন
বসবে।”
মাও সাথে সাথে সাঁই
দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছেন। খুজুন না মেয়ে। ছেলেকে না হয় রাজি করালাম।”
চাচাও বলল, “ঠিক আছে,
দেখছি সব কিছু।”
অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।
ফিরিয়ে নিয়ে আসলাম নতুন জীবনে। এদিকে বাবা-মাও আমার বিয়ে ঠিক করল। আমার মতেই বিয়ের
আয়োজন করল। হয়ত রুপন্তির ছায়া-ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু একজন
প্রিয়াঙ্কাকে আমি মিস করব আজীবন। পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি সে
যেন সবসময় সুখে থাকে, যতই সে আমাকে কষ্ট দিক না কেন।